শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

হীরাঝিলের আর্তনাদ!

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

ভাগিরথীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠেছিল ঐতিহাসিক হীরাঝিল প্রাসাদ। বাংলার নবাব আলীবর্দী খানের ম্নেহের দৌহিত্র মীর্জা মোহাম্মদ এই প্রাসাদ গড়েছিলেন দীর্ঘকালের পরিক্রমায়। বলা যায় তিনি যখন যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তখন থেকেই এই স্বপ্নীল প্রাসাদটি গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন। ইচ্ছা ছিল তিনি যখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন, তখন এই প্রাসাদ থেকে প্রজাসাধারণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হবে। জনগণের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও হাসি-কান্নার সাথে একাকার হয়ে যাবেন তিনি। তাই এই সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণের জন্য গৌড় হতে নানান ধরনের প্রস্তরাদি এবং মূল্যবান উপকরণও সংগ্রহ করেছিলেন বাংলার ভাবি নবাব। তিলেতিলে গড়ে তুলেছিলেন এই তিলোত্তমা সদৃশ প্রাসাদটি।

১৭৫৬ সালে নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যু হলে প্রথাসিদ্ধ নিয়মে ম্নেহেরদৌহিত্র ও যুবরাজ মীর্জা মোহাম্মদ ‘মনসুরুল মুলক মীর্জা মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা’ উপাধী ধারণ করে বাংলার মসনদে আসীন হলেন। যদিও ইংরেজরা তার নাম উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হয়ে বলতো ‘Sir Roger Dowlet’. যাহোক স্বপ্নেরহীরাঝিল প্রাসাদেই নতুন নবাবের অভিষেক হলো। অভিষেকের পরই তিনি প্রজা সাধারণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘভে সচেষ্ট হলেন। পূর্বসূরীর পরামর্শমত ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর যাবতীয় অন্যায়-অনাচার-ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। ফলশ্রুতিতে তাকে কাসিমবাজার কুঠি ও কোলকাতা দখল করতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হলো।

তিনি অসীম সাহসিকতা ও শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করে কুঠিয়ালদের পরাভূত করতে সক্ষম হলেন। অতিঅল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন প্রজাবৎসল, দেশপ্রেমী ও অকুতোভয় জাতীয়তাবাদী বীর হিসেবে সাধারণ মানুষের মনে মণিকোটায় স্থান করে নিলেন। কিন্তু তা সহ্য হলো না মীর জাফর, রাজা রাজবল্লভ, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, ইয়ার লতিফ ও ঘসেটি বেগম গংদের। তারা যেকোন মূল্যে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ষড়যন্ত্র করতে লাগলো। আর সে ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতেই হলো ঐতিহাসিক পলাশী প্রান্তরের যুদ্ধ নামের নির্মম প্রহসন।

ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় এসব ইতিহাসের খলনায়করা প্রজাবৎসল, স্বাধীনচেতা ও দেশপ্রেমী নবাবের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে শুরু করলো। সদ্য অভিষিক্ত নবাবের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা, অসৌজন্যতা ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার অভিযোগ উত্থাপন করা হলো। কথিত নৃশংস অন্ধকূপ হত্যার অপবাদও দেয়া হলো তরুণ নবাবের চরিত্রে। যা ছিল কল্পনারও অতীত। মূলত এসব অভিযোগের সাথে নবাব সিরাজের দূরতম সম্পর্কও ছিল না বরং তিনি অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সবসময় ছিলেন আপোষহীন, অকুতোভয় এবং দেশ-জাতির কল্যাণে আত্মোৎস্বর্গকারী। আর এসবই ছিল নবাব বিরোধীদের মাথা ব্যথার প্রধান কারণ।

তাই এসব বিভীষণরা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে যোগ দিয়ে নবাবের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। শেষ পর্যন্ত মোক্ষম সুযোগও এসে গেল। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং তাদের উপমহাদেশীয় এজেন্টদের সাজানো পলাশীর আম্রকাননের কথিত যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব পরাজিত হলেন এবং পরে তাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। আরহীরাঝিল প্রাসাদের আর্তনাদ শুরু হলো তখন থেকেই। কিন্তু সে আর্তনাদ থামছে না শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। থামার কোন সম্ভবনাও দেখা যাচ্ছে না। কারণ, মীর জাফর ও জগৎ শেঠের প্রেতাত্মারা আজও তৎপর।

যে আশায় বুক বেঁধে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও তাকে নির্মম এবং নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীদের সে উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। নবাব সিরাজের স্ত্রী-কন্যা সহ প্রাসাদ ত্যাগের পরহীরাঝিল প্রাসাদে লর্ড ক্লাইভ নিজে হাত ধরে মীর জাফরকে বাংলার সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতককে ইংরেজরা কখনো বিশ্বাস করে নি। ষড়যন্ত্রকারীরা ভেবেছিল যে, নবাব সিরাজের পতনের পর তারাই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ভাগ্য বিধাতা হিসেবে অবির্ভূত হবে। কিন্তু যারা ক্ষমতার লোভে দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল ইংরেজরা তাদেরকে কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারেনি। তাই মীর জাফরকে পদচ্যুত করে তার জামাতা মীর কাসেম আলী খানকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল।

মীর কাসেম ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ১৭৬৩ সালে কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ, গিরিয়া, সুতি, উদয়নালা ও মুঙ্গের যুদ্ধে ইংরেজদের সাথে পরাজিত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন। আবার নিজেদের স্বার্থেই ইংরেজরা তাদের গর্দভ খ্যাত মীর জাফরকে ক্ষমতায় বসায়। ১৭৬৪ সালে বাংলার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য মীর কাসেম আলী খান ইংরেজদের সাথে বক্সারের যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও তাকে নির্মমভাবে পরাজয় বরণ করতে হয়। কিন্তু এরপরও মীর জাফরের পথচলা নিষ্কন্টক হয়নি বরং স্বার্থ ফুরালে মীর জাফরের পুত্র মিরনকে ইংরেজরাই হত্যা করেছিল বলে জানা যায়। আর পলাশীর ধারাবাহিকতায় এক সময় পুরো ভারতবর্ষই কোম্পানীর শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়।

যারা আত্মস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষুদ্রস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে তুলে দিয়েছিল তাদের জীবনটাও খুব সুখকর হয়নি বলেই ইতিহাস থেকে জানা যায়। ইংরেজরা তো এদেরকে কোনভাবেই মূল্যায়ন করেনি বরং ১৭৬০ সালে ইংরেজরা মীর জাফরকে পদচ্যুত ও তার জামাতা মীর কাসেম আলী খান নবাব হওয়ার পর ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে আজিমাবাদের নায়েবে নাজিম রামনারায়ণ, গোয়েন্দা কর্মকর্তা রাজা মুরলী ধর, পলাশীর অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী জগৎ শেঠ, উমেদ রায় ও রাজ বল্লভকে গ্রেফতার এবং সকলকেই প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হয়। ফলে এসব বিভীষণরা কোন পক্ষের কাছেই মূল্যায়িত হয়নি বরং তাদেরকে লাঞ্ছনা ও জিল্লতির জীবনই যাপন করতে হয়েছে। আর তা থেকে মুক্ত নন তাদের নিরাপরাধ বংশধরটাও। ইতিহাসের এই কালিমা তাদেরকেও এখন তাড়া করে ফিরছে।

পলাশী ট্রাজেডির পর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ক্ষমতার দৃশ্যপটে আগমনকে ভারতবর্ষের বিশেষ একটি শ্রেণি ঈশ্বরের আশীর্বাদ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন এবং ইংরেজ শাসন দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও রেখেছিলেন। নবাব সিরাজের পতনের পর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর তাদের একটা উচ্ছিষ্টভোগী শ্রেণি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। বিদেশী শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিল। কারণ, বিদেশী শাসকরা ‘Divide & Rule’ থিওরীতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করে অন্যদের উপর অত্যাচারের ষ্টিম রোলার চালাতো। এসব সুবিধাভোগী শ্রেণি ও ইংরেজদের তল্পিবাহকদের দেয়া হয়েছিল ‘স্যার’ ও ‘নাইট’ সহ বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় খেতাব। (চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ