বুধবার ০১ মে ২০২৪
Online Edition

নিরাপদ খাতনাই কাল হলো আয়ানের

অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন 

চিরসত্য মৃত্যুকে অস্বীকার করার সুযোগ বা সাধ্য জগত সংসারে কারও নেই। তবু মানুষ অন্তকাল বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা করে। কিন্তু কেউ চিরদিন বেঁচে থাকে না। সবাইকে আপন প্রভুর সান্নিধ্যে ফিরে যেতে হয়। তবে কিছু মানুষের মৃত্যু সবাইকে নাড়িয়ে দেয়। যেমন আয়ানের মৃত্যু। আয়ানের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক না হলেও হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। কারণ প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ানো শিশুর যখন খাতনা করানোর জন্য মৃত্যু হয় তখন মনে দাগ কাটে। আয়ানের মৃত্যু প্রত্যেকটি বিবেকবান মানুষের মনে ব্যথা দিয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, রাজধানীর বাড্ডা-সাঁতারকুল এলাকার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিরাপদ খাতনা করার প্রত্যাশায় আয়ানের পরিবার হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু শিশু আয়ানের খাতনা করানোর পর আর জ্ঞান ফিরেনি। শিশু আয়ানের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। স্বাভাবিক মৃত্যু যেখানে মেনে নিতে কষ্ট হয় সেখানে চিকিৎসকের অবহেলা কিংবা ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হওয়া কত যে কষ্টের তা আয়ানের পরিবার ব্যতীত অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। খাতনা করাতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা কারও কারও কাছে অবিশ^াস্য মনে হতে পারে। কিন্তু অবিশ^াস্য হলেও সত্য যে, ৭ জানুয়ারি রোববার রাত ১১টা ২০ মিনিটে চিকিৎসক আয়ানকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকের ভাষ্যমতে আয়ানের মৃত্যুর কারণ কার্ডিও-রেসপিরেটরি ফেইলিওর, মাল্টিঅর্গান ফেইলিওর এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। কিন্তু আয়ানের পরিবার ভিন্ন কথা বলছেন যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ কত যে ভারী হয় তা একমাত্র ভুক্তভোগী পিতাই অনুধাবন করতে পারেন। আয়ানের পরিবার পরিজনকে সান্ত¡না দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই। তবে আরশের মালিকের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন দয়া করে পুরো পরিবারকে এ শোক সইবার তাওফিক দান করেন।

ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু প্রতিকার কেউ পাচ্ছেন না। আমরা যখন অসুস্থ হই তখন বাধ্য হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। ভুল চিকিৎসার কারণে প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা বেদনা কত যে কষ্টের তা লিখে কাউকে বুঝানো যাবে না। কঠিন ও জটিল অস্ত্রোপচার ভুল হলে মনকে সান্ত¡না দেয়া যায়। কিন্তু খাতনা করাতে গিয়ে জীবন চলে যাওয়ার সান্ত¡না কী দেয়া যায়? খাতনা করাতে গিয়ে ভুল চিকিৎসার শিকার হওয়া দুঃখজনক। এর আগে ভুল চিকিৎসায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে নবজাতক ও প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ৭ জানুয়ারি রাতে ইউনাটেড হাসপাতালে আয়ানের মর্মান্তিক মৃত্যু হওয়াটা বেদনাদায়ক। আয়ানের মৃত্যুর খবর যখন খবরের কাগজে পড়েছিলাম তখন দ্রুত পাতা উল্টিয়ে ফেলেছিলাম। কারণ এ মৃত্যু ভুলার নয়। এ মৃত্যু মেনে নেয়ার মতো নয়। ৫ বছরের একটি ফুটন্ত গোলাপ ফুল হয়ে ফোটার আগেই এভাবে বিদায় নেবে তা আমরা কেউ প্রত্যাশা করি না। আমার বিশ্বাস আয়ানের হাসিমাখা ছবি যারাই দেখেছে সবার হৃদয়ের ক্যানভাসে জায়গা করে নিয়েছে। আয়ানের মৃত্যুর সঠিক কারণ আমরা জানি না। আয়ানের বাবা শামীম আহমেদের ভাষ্য পুরোপুরি পাঠকদের খেদমতে তুলে ধরছি। গত ৩১ ডিসেম্বর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাচ্চার সুন্নতে খাতনা করাতে নিয়ে যাই। সেখানে যাওয়ার পর বাচ্চাটিকে প্রথমে অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া হয়। এরপর সেখানে ওই অবস্থায় তাকে দিয়ে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ২ ঘন্টা ক্লাস নেয়া হয়। শেষের দিকে যখন তারা বাচ্চার পালস পাচ্ছিল না, তখন ডাক্তাররা আয়ানের বুকে বার বার প্রেসার দিচ্ছিল। তখনই আমরা বুঝতে পারি, কিছু একটা ভুল হয়েছে। কিছুক্ষণ পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায় উন্নত চিকিৎসার জন্য আয়ানকে গুলশান-২ ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেখানে নিয়ে যায় এবং লাইফসাপোর্টে রাখা হয়। কিন্তু আয়ানের জ্ঞান আর ফিরেনি। আংশিক অচেতন করে খাতনা করানোর কথা থাকলেও চিকিৎসকরা আয়ানকে পুরোপুরি অজ্ঞান করেছিল। চিকিৎসকের ভুলের কারণে আমার ছেলেটা মারা গেছে। চিকিৎসকদের গাফিলতিকে দায়ী করে তিনি গণমাধ্যমে বলেন-এতদিন তারা মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে টালবাহনা করছিল। শেষে নির্বাচনের দিনকে টার্গেট করা হয়, যাতে গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে কম প্রচার পায়। তিনি এই হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন। 

আয়ানের বয়স পাঁচ বছর নয় মাস। আয়ানের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া এলাকায়। শিশু আয়ান ঢাকার পূর্বাচলের জলসিড়ি ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের নার্সারির ছাত্র। পত্রিকার খবরান্তে জানতে পারলাম যে, শিশুর অভিভাবকদের অনুমতি ব্যতীত ৫ বছরের আয়ানকে ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে সুন্নতে খাতনা (মুসলমানি) করান চিকিৎসকরা। শিশুটিকে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করেন ডা. সাব্বির আহমেদ। আর সার্জারি করেন ডা. মেহজাবীন। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চাকে ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া যায় কিনা তা চিকিৎসকেরাই ভালো বলতে পারবেন। সুতরাং আমরা মনে করি বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করানোর জন্যই আয়ানকে জীবন দিতে হয়েছে এমন অভিযোগ পরিবারের পক্ষ থেকে হাসপাতালের বিরুদ্ধে উত্থাপন করা হয়েছে। তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মুসলিমদের জন্য খাতনা করা সুন্নত। ফলে প্রতিটি মুসলিম পরিবার উৎসাহের সাথে সন্তানের খাতনা করায়। গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের ছেলেদের হাজাম দ্বারা মুসলমানি করানো হয়। কিন্তু শহরে হাসপাতালে খাতনা করানো হয়। তাছাড়া কিছু বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাও খাতনার জন্য ক্যাম্পের আয়োজন করে। কিন্তু কোথাও মর্মান্তিক মৃত্যু হওয়ার খবর শোনা যায়নি।

সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের ভালোবাসা পরিমাপ করার যন্ত্র আজও আবিষ্কার হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। একজন বাবা-মা নিজের জীবনের চাইতে সন্তানকে বেশি ভালোবাসেন। তার প্রমাণ সন্তান নিজেই। সন্তান যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন বাবা-মায়ের হৃদয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ে কখন সন্তান সুস্থ হয়ে উঠবে। সন্তানের সামান্য জ্বর হলে মায়েরা সারা রাত জেগে আরশের মালিকের কাছে ফরিয়াদ জানায়। বলে ওগো আল্লাহ আমার সন্তানের জ্বরটা আমাকে দিয়ে দিন। তবু আমার সন্তানকে সুস্থ করে দিন। এমন আকুতি প্রায় বাবা-মায়েরাই করেন। প্রত্যেক বাবা-মায়ের মতোই আয়ানের বাবা-মা নিরাপদ খাতনা করার জন্য কলিজারটুকরা আয়ানকে গোসল করিয়ে নতুন জামা-কাপড় পড়িয়ে সাজিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসকের ভুলের কারণে ফুল হয়ে ফোটার আগেই বাবা-মায়ের কোলে লাশ হয়ে ফিরলেন আয়ান। 

 

 সুন্নতে খাতনা কী এমন অস্ত্রোপচার যা করতে শিশুকে একেবারে জীবন দিতে হল; তা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জাতির সামনে উন্মোচন করা প্রয়োজন। ভালো সেবার প্রত্যাশায় আয়ানের বাবা হাসপাতালে গিয়েছিল। কিন্তু সেবার পরিবর্তে সন্তানের লাশটা উপহার পেল। এ দায় কার? এ ঘটনা ঘটনার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে- ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল কোনো নিবন্ধন ছাড়াই চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। তাহলে অধিদপ্তর কোথায় ছিল? একটা মেডিকেল কলেজ কিভাবে অনুমোদন ছাড়া রাজধানীর মতো স্থানে সেবার নামে মানুষ মারার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কোন হাসপাতালের অনুমোদন আছে আর কোন হাসপাতালের অনুমোদন নেই তা তো সাধারণ রোগীদের জানার কথা না। আমরা আশা করবো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদনকৃত মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের লিস্ট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করবেন যেন আর কোন মায়ের বুক খালি না হয়। তবে ধন্যবাদ জানাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তারা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। ওই মেডিকেল কলেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। আমরা সুষ্ঠু বিচারের অপেক্ষায় রইলাম। সরকার অতি দ্রুত দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি ও প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর মান নিশ্চিত করার স্বার্থে মনিটরিং করার ব্যবস্থা করবে, যেন আর কোন আয়ানের মায়ের বুক খালি না হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ