শনিবার ১৮ মে ২০২৪
Online Edition

‘ইন্ডিয়া আউট’ শ্লোগানের পক্ষে মালদ্বীপের জনগণের রায়

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, মালদ্বীপ থেকে : গত ২১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মালদ্বীপের পার্লামেন্ট নির্বাচন। এবারের নির্বাচনটি বর্তমান সরকারের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জের ছিল। এই নির্বাচন ঘিরে ভারত ও চীনের মধ্যে এক ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতাও লক্ষ্য করা গেছে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে মালদ্বীপের জনগণ তাদের নিজস্বতাকেই বেছে নিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশের বলয় থেকে বেরিয়ে চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেসকে (পিএনসি) বড় ব্যবধানে জয়ী করেছে। প্রকাশিত প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, দেশটির ৯৩ আসনের পার্লামেন্টে পিএনসির প্রার্থীরা দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়েছে। নির্বাচনে বিপুল জয় প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর চীনপন্থি নীতির প্রতি সমর্থন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। চীনপন্থি হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ মুইজ্জু বরাবর ‘ভারত’ নীতির বিরোধিতা করে এসেছেন।

মালদ্বীপের নির্বাচন কমিশন পার্লামেন্টের যে ৮৬টি আসনের ফল প্রকাশ করেছে তার মধ্যে পিএনসির প্রার্থীরা পেয়েছেন ৭০টি আসন। পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য এ অবস্থান যথেষ্ট। রোববারের নির্বাচনের এই ফল ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দেশটিকে দীর্ঘ দিনের মিত্র ভারত থেকে দূরে সরিয়ে চীনের আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

মালদ্বীপের এবারের সংসদ নির্বাচন দু’টি কারণে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। মুইজ্জুর ‘ভারতবিরোধী অবস্থান’ এবং ‘চীন ঘেঁষা নীতি’ মালদ্বীপের মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য তা পরখ করার একটা পরিসর তৈরি করেছিল এই নির্বাচন।

মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এরইমধ্যে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন তিনি। এমনকি, মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাসদস্যদের সরানোর নির্দেশও দেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার মালদ্বীপ থেকে সেনাসদস্যদের সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে।

এই আবহের মধ্যেই হয় দেশের পার্লামেন্ট নির্বাচন। মালদ্বীপের বিরোধী দলগুলো মুইজ্জু সরকারের ভারতবিরোধী অবস্থানের বিরোধিতা করে প্রচারও করে। কিন্তু কোনো কিছুই মুইজ্জুর দলের পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পথে বাধা হতে পারেনি।

দেশটির নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালদ্বীপে দীর্ঘদিন ধরে থাকা ভারতের প্রভাব কমাতে ‘ইন্ডিয়া আউট’ শ্লোগান দিয়ে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন চীনপন্থি মোহামেদ মুইজ্জু। নির্বাচনে তার প্রধান প্রচারণা ছিল পূর্ববর্তী সরকারের নেওয়া ‘ভারত প্রথম’ নীতির অবসান ঘটানো। সেই মুইজ্জুর দল পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস (পিএনসি) দেশটির সংসদ নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছে। ফলে মালদ্বীপের রাজনৈতিক পরিসরে মুইজ্জুর হাত আরও শক্ত হলো। 

সূত্র মতে, মালদ্বীপের  পরিকাঠামোগত উন্নয়নে হাত লাগিয়েছে চীনা সংস্থা। ভারতের সেনাকর্মীদের সরানো হয়েছে সেখান থেকে। এই আবহে দিল্লি এবং মালের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়তে পারে ভবিষ্যতে। আগে স্বাস্থ্য, খাদ্যের মতো অত্যাবশ্যক ইস্যুতে ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল মালদ্বীপ। তবে সেই নির্ভরশীলতা কমাতে বিগত দিনে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি করেছে দেশটি। তুরস্ক থেকে ড্রোনও কিনেছে মালদ্বীপ। সমুদ্রে নজরদারি চালানোর জন্য সেই চুক্তি করা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য জরুরি উদ্ধার কাজে শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও সম্প্রতি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে মালদ্বীপ। এই আবহে সংসদীয় নির্বাচনে মুইজ্জুর দলের বড় জয়ের ফলে ভারত থেকে আরও দূরে সরতে পারে ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র।

মালদ্বীপে উদ্ধার ও পুনরুদ্ধার কাজের জন্য দুটি হেলিকপ্টার এবং একটি বিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য মালদ্বীপে প্রায় ৮৫ জন ভারতীয় সামরিক কর্মী ছিলেন। বছর কয়েক আগে দিল্লির তরফে এ বিমান অনুদান হিসাবে দেওয়া হয়েছিল।

ভারতীয় সেনা ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্তের কারণে দিল্লির সঙ্গে মালের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্কে এই টালমাটাল পরিস্থিতিকে বেইজিং কাজে লাগাতে আগ্রহী বলেই মনে করা হয়।

মালদ্বীপের নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, রোববার ভোট পড়েছে প্রায় ৭৩ শতাংশ, তবে এ সংখ্যা ২০১৯ সালের পড়া ভোটের (৮২ শতাংশের) চেয়ে কম।

ভোটের ফলাফলের পর এমডিপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা মুইজ্জুকে অভিনন্দন জানান। দলটির চেয়ারপার্সন ফাইয়াজ ইসমাইল সামাজিক মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন- এমডিপির সংসদ সদস্যরা আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উন্নতির জন্য দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসেবে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।

মালদ্বীপের এবারের নির্বাচনকে মোহাম্মদ মুইজ্জুর জন্য ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। কারণ, চীনপন্থি মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হলেও পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার পূর্বসূরি ভারতপন্থি ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহর দল মালদিভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি) হাতে। ফলে পিএনসি পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে কি না, এটাকে তার জন্য চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছিল। নির্বাচনে মুইজ্জুর দলের এই বড় জয়ের অর্থ, ভারতের দিকে না-গিয়ে চীনের দিকে রাজনৈতিক ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও তার দলকেই দেশবাসী সমর্থন দিয়েছে।

কেন গুরুত্বপূর্ণ এই ফলাফল? : গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারতবিরোধী অবস্থান প্রকাশ করে বিজয়ী হন মুইজ্জু। তিনি মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের মতো চীনপন্থি অবস্থান নেন। দুর্নীতির অভিযোগে ইয়ামিনের ১১ বছরের কারাদ- হয়েছিল। তবে গত সপ্তাহে আদালত এ সাজা বাতিল করলে তিনি মুক্তি পান। মোহাম্মদ মুইজ্জুর দলের এবারের জয়কে ‘সুপার মেজরিটি’ হিসেবে বর্ণনা করেছে স্থানীয় গণমাধ্যম। সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে যে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা দরকার, এই নির্বাচনের মাধ্যমে তার দল পিএনসি সেটি অর্জন করেছে।

মোহাম্মদ মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হলেও দেশটির পার্লামেন্ট পিপলস মজলিশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বিরোধী পক্ষের আইনপ্রণেতাদের আপত্তিতে তার মনোনীত তিনজনের মন্ত্রিসভায় যোগদান আটকে যায়। মুইজ্জু প্রস্তাবিত কয়েকটি বিল পাসেও আপত্তি জানান বিরোধীরা। 

আগের পার্লামেন্টে ভারতপন্থি হিসেবে পরিচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহর দল এমডিপির নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে এবারের নির্বাচনে দলটি মাত্র ১৫টির মতো আসনে জয় পেয়েছে। ফলে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় মুইজ্জুর সরকারের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।

মালদ্বীপের বিশ্লেষক ও ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার লেকচারার আজিম জহির বলেন, মুইজ্জুর জন্য এটা উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি। এই জয়ের ফলে রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবার মুইজ্জু সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন। তাত্ত্বিক দিক থেকে বিচার বিভাগকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তিনি। কারণ সংসদে পর্যাপ্ত আসন পেয়েছে তার দল।

বিশ্লেষক জহির বলেন, এখন একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করার আরও অবকাশ রয়েছে। কিন্তু দিল্লি যদি সম্পর্ককে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে না পারে এবং তাকে (প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুকে) সাহায্য করতে অসম্মতি জানায়, তাহলে অবশ্যই মালে বেইজিংয়ের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।

এদিকে মালদ্বীপের এই নির্বাচনকে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য মুইজ্জুর পরিকল্পনার পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। প্রেসিডেন্টর দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি বেইজিং সফর করেন। সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ দেশটির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সেই সফরে তিনি বেইজিংয়ের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেন।

মালদ্বীপের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ভারতের জন্য অবশ্যই চিন্তার বিষয়। দেশটির বিদেশনীতি বিশেষ করে, ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করা হচ্ছে। মুইজ্জুর জয় চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা বাড়বে যা ভারত মহাসাগর অঞ্চলে কৌশলগত ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ