শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

আমদানির নেপথ্যে পাচারের আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের

এইচ এম আকতার: আবারও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে ডলারের দাম। চলতি অর্থবছরের জুলাই শেষে আন্তঃব্যাংক ডলারের দর ছিল ৮০ দশমিক ৬৬ টাকা। গতকাল মঙ্গলবার এই দর বেড়ে হয়েছে ৮২ দশমিক ৯৪ টাকা। তবে এদিন নগদ টাকায় ডলার বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৮৫ দশমিক ২৫ টাকায়। এই হিসাবে গত ৭ মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৪ দশমিক ৫৯ টাকা। আমদানির অজুহাতে ডলারের দাম বাড়লে নেপথ্যে পাচার হচ্ছে এমন আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। এতে করে অর্থনীতিতে কালো টাকা বাড়ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির বিপরীতে রপ্তানি ও রেমিটেন্স প্রবাহ কম হওয়ায় এবং বৈশ্বিকভাবে চাহিদা বাড়ায় ডলারের দাম বাড়তে পারে।
তারা আরো বলছেন, নগদ অর্থকে নিরাপদে রাখতে হয়তো কেউ কেউ নগদ টাকায় ডলার কিনে তা পাচার কিংবা নিজেদের কাছে জমা করছে। ফলে হু হু করে দাম বেড়ে যাচ্ছে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকগুলো যে দরে ডলার বা অন্য মুদ্রা কেনাবেচা করে তাকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বিনিময় হার বলা হয়। যুক্তির কোন কারণ ছাড়া ডলারের দাম বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের আমদানিকারকরা। রপতানি কারকরা কিছুটা সুবিধা পেলেও অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাবই বেশি। দেশে দৃশ্যমান বড় ধরনের কোন বিনিয়োগ নেই। তারপরেও ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বাড়ছেই। প্রশ্ন হলো ব্যাংক ঋণের এই টাকা যাচ্ছে কোথায়। দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করছে এমন ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
জানা গেছে, এখন আমদানি প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ। কিন্তু এসব আমদানি পণ্যের বেশির ভাগ হলো তুলা আর মূলধনী যন্ত্রপাতি। কিন্তু গত এক বছরে দেশের কোন স্পিনিং মিলের সংখ্যা বাড়েনি। তাহলে আমদানি হওয়া এত তুলা গেলো কোথায়। গত বছরের তুলনায় এ বছর তুলা আমদানি বেড়েছে প্রায় ১০ গুন। তাহলে কি তুলা আমদানির নামে বিদেশে টাকা পাচার করা হয়েছে!
একইভাবে বেড়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি। এখানেও একই অবস্থা দেখা গেছে। দেশে বড় ধরনের কোন বিনিয়োগ নেই। কোনভাবেই বিনিয়োগের খরা কাটছে না। তাহলে আমদানি করা মূলধনী যন্ত্রপাতি যাচ্ছে কোথায়? এই দুটি পণ্য আমদানিতে কোন শুল্ক নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডলার বিক্রি করেছে ৮২ টাকা ৯০ পয়সা দরে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ওই দরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনেছে। আর গ্রাহকের কাছে বিক্রি করেছে সর্বোচ্চ ৮৫ দশমিক ২৫ টাকা। সেই হিসাবে তারা প্রতি ডলারে ৪ দশমিক ৫৯ টাকা বেশি নিচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান গত এক বছরে ক্রমাগত কমছে। তাতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়লেও বেড়েছে আমদানি ব্যয়।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে বিক্রি করেছিল মাত্র ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
বিপরীতে কিনেছিল ১৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত কয়েক মাসে বাজারে প্রচুর ডলার ছেড়ে দাম ঠিক রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য গত দুই-তিন মাসে দাম ব্যাপক হারে না বাড়লেও ডলারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। এক বছর আগের চেয়ে এখন বেড়েছে সাড়ে চার টাকার বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, মঙ্গলবার ডলারের আন্তঃব্যাংক দর ছিল ৮২ দশমিক ৯৪ টাকা। অন্যদিকে আমদানি পর্যায়ে ব্যাংকগুলোর ডলারের দর ছিল সর্বোচ্চ ৮৩ দশমিক ৫০ টাকা। বিদেশি ওরি ব্যাংকের ডলারের দর ছিল আন্তঃব্যাংক দরের থেকেও কম, ৮২ দশমিক ৩৫ টাকা। একই দিন নগদ টাকায় ডলার বিক্রি সর্বোচ্চ দর হেঁকেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবিএল)। এই ব্যাংকটির ডলারের দর ছিল ৮৫ দশমিক ২৫ টাকা। তবে ইস্টার্ণ ব্যাংকে ডলারে দর ছিল ৮৩ টাকা, যা তুলনামূলক কম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফএসআইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মো. ওয়াসেক আলীকে ফোন দিলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।
সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নিয়োজিত অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় ডলারের দর বাড়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দর যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে এবং প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ডলার কিনে না রাখতে নিষেধ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের ৬ মাসেই এলসি খোলার পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বছর শেষে এই অঙ্ক ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৬ শতাংশ। কিন্তু রপ্তানি আয় বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্বনর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, সাধারণত যে জিনিসের চাহিদা বেশি হয়, তার দাম বাড়ে। এখন বুঝা যাচ্ছে ডলারের চাহিদা বাড়ছে। ফলে দামও বাড়ছে। কিন্তু কেন চাহিদা বাড়ছে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দেখতে হবে, আমদানি বাড়ছে কি না। তবে আমার ধারণা, যে হারে ডলারের দাম বাড়ছে, সেই হারে আমদানি বাড়েছে না।
তিনি বলেন, রপ্তানি বাড়লেও ডলারের দাম বাড়ে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য হারে এখন রপ্তানি বাড়ছে-এমন চিত্রও চোখে পড়ে না। এছাড়া রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেলেও ডলারের দাম বাড়ে। তবে রেমিট্যান্স তো তেমন কমেনি বরং এখন বাড়ছে।
তাই এসব বিষয়ে বিবেচনা করলে সন্দেহ তৈরি হয় যে, হয়তো কেউ কেউ নগদ টাকায় ডলার কিনে তা পাচার করছে অথবা জমা করছে। কারণ বিভিন্ন দিক চিন্তা করে অনেকে ডলার জমা করেও রাখতে পারে। তাই নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
দুটো কারণে ডলারের দাম বাড়তে পারে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি  বলেন, বৈশ্বিকভাবে ডলারের চাহিদা ও দেশে আমদানি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির কারণে ডলারের দাম বাড়ছে।
গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ডলারের চাহিদা বাড়ছে, তাই বিশ্বের অন্যন্য দেশ থেকে সেখানে ডলার যাচ্ছে। ফলে শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত, ভিয়েতনাম ও শ্রীলংকায়ও ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমছে। এ কারণে ডলারের ডাম বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, এছাড়া দেশে আমদানি বেড়েছে। এখাতে এখন প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ। আর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ ১২ শতাংশ। অর্থাৎ আমদানি বেশি কিন্তু রপ্তানি কম। তাই চাহিদার তুলনায় সরবারহ কম থাকায় ডলারের দাম বেশি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
তবে হ্যাঁ আমদানিটা আসলে অতিমাত্রায় হচ্ছে কিনা এবং কি আমদানি হচ্ছে তা দেখা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নিয়ে আগেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সতর্ক বার্তাও পাঠিয়েছে ব্যাংকের এমডিদের কাছে। এতে কিছু দিন ডলারের দাম কিছুটা কম থাকলেও আবারও বেড়েছে ডলারের দাম। কিন্তু তেমন কোন যুক্তর কারন খুজে পাচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।
সাবেক এক গর্বনর বলেন, দাম নিয়ন্ত্রণে কোন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কোন পনের‌্য সরবরাহ কমলেই তার দাম বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি ডলারের সরবরাহ স্বভাবিক করে দেন তাহলেই দাম কমে যেতো। তারা গত বছরের তুলনায় সরবরাহ বাড়িয়েছে। কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় কম বলে মনে হচ্ছে। আমদানির অজুহাতে ডলারের দাম বাড়লেও আসলে আমদানির নামে কি হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
দেশের ব্যাংক ঋণ যে হারে বাড়ছে সে হারে দৃশ্যমান বিনিয়োগ কম। তাহলে এত ঋণের টাকা যাচ্ছে কোথায়। একইভাবে আমদানি প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ হলেও আসলে আমদানি নামে কি হচ্ছে তা মনিটরিং হওয়া দরকার। তাহলেই ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ